মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার শেখ হাসিনা সরকারের সবচেয়ে সাহসী ও প্রশংসিত কাজ। এই বিচারকে কেন্দ্র করে বার বার আলোচনায় এসেছে ইসলামী ব্যাংক। মানবতাবিরোধী অপরাধী জামায়াত নেতাদের আয়ের অন্যতম উৎস ইসলামী ব্যাংক, বলা হয়েছে বার বার। মানবতাবিরোধী অপরাধীরা ইসলামী ব্যাংকসহ তাদের আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের অর্থ দেশে-বিদেশে ব্যয় করেছে বিচার বন্ধের চাপ তৈরির লক্ষ্যে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি, তাদের অর্থের উৎস বন্ধ করার দাবি ছিল জোরালো। সেই লক্ষ্যে সরকার কাজও করছিল অনেক দিন ধরে। যা এখন দৃশ্যমান হলো। জামায়াত সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান, এমডিসহ আরও অনেক পদে পরিবর্তন সম্পন্ন হলো। আরও পরিবর্তন হচ্ছে। সরাসরি জামায়াত নেতাদের আর কোনও সম্পৃক্ততা থাকছে না ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে।
ইসলামী ব্যাংক এতদিন জামায়াত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচালনা করেছেন। পরিবর্তিত নতুন কর্তারা বলেছেন ব্যাংক পরিচালনা বা নীতিতে পরিবর্তন আসবে না। শরিয়া ভিত্তিতেই চলবে। কর্মকর্তাদের আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া বা চাকরিচ্যুত করা হবে না। অন্য ধর্মের লোকদেরও চাকরি দেওয়া হবে, এতদিন যা দেওয়া হতো না। মূলত জামায়াত-শিবির সংশ্লিষ্টরাই চাকরির সুযোগ পেত ব্যাংকটিতে। এসব আশা জাগানো বক্তব্য দায়িত্ব নেওয়ার পরই বলেছেন, নতুন চেয়ারম্যান, এমডি। কিন্তু বাস্তবে কী ঘটছে? এই বক্তব্যের প্রতিফলন কাজের ক্ষেত্রে কতটা থাকছে? আশা, আশঙ্কায় পরিণত হচ্ছে কিনা?
দু’টি রিপোর্টের অংশ বিশেষ দেখে নেওয়া যাক:
ক. ‘কোনও নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করেই নিয়োগ দেওয়া শুরু করেছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। গতকাল সোমবার পর্যন্ত ২৬ জন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিয়ে বিভিন্ন শাখায় পোস্টিংও দেওয়া হয়েছে। দেশের একটি বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর তালিকা অনুযায়ী আরও ২৫০জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে মেধারভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে বলে ব্যাংকটির নতুন পরিচালনা পর্ষদ সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দিলেও বাস্তবে ঘটছে উল্টো।’ এমনই একটি তথ্য প্রকাশ করেছে দেশের একটি দৈনিক পত্রিকা।
খ. ১২ জানুয়ারি, ২০১৭ একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম ছিল- ‘মাত্র ৫৫ মিনিটে ৭৫ জনের ভাইভা’।
১. দায়িত্ব নিয়ে নতুন চেয়ারম্যান এমডি যা বলেছেন, এই দু’টি ঘটনায় তার প্রতিফলন আছে? এক কথায় উত্তর দেওয়া যায় ‘নেই’। তার মানে কথা ও কাজের মিল নেই বা থাকছে না।
ব্যাংকের নতুন নেতৃত্ব, নতুন নিয়োগ দেবে- এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তাদের মতো করে ব্যাংক পরিচালনার জন্য, নিজেদের পছন্দের লোক অবশ্যই প্রয়োজন আছে। তাই বলে নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়মমাফিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করবে না? ৫৫ মিনিটে ৭৫ জনের ভাইভা নেবে?
এমন তো না যে, ইসলামী ব্যাংক কর্মীশূন্য হয়ে পড়েছে, কাজের লোক পাওয়া যাচ্ছে না। তাই পরীক্ষা নেওয়ার সময় নেই, ভাইভা নেওয়ার সময় নেই। তড়িঘড়ি করে পরীক্ষা ছাড়া নিয়োগ দিতে হবে। পর্যাপ্ত ও যোগ্য লোকবল ছিল বলেই তো ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের এক নম্বর ব্যাংক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। এখন যাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তারা যদি যোগ্য হতেন, তবে পরীক্ষা ছাড়া নিয়োগ দেওয়ার প্রয়োজন পড়ত না। নিয়োগ প্রক্রিয়া দেখে সন্দেহ করার যথেষ্ট যৌক্তিকতা আছে যে, অযোগ্য-অদক্ষ দলীয় লোকজনকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। মালিকানায় আসা বৃহৎ ব্যবসায়ী গ্রুপের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা শুরু করেছেন নতুন চেয়ারম্যান, এমডি।
পদোন্নতি এক বছর ধরে আটকে আছে, এই বিবেচনায় ৪১ সেকেন্ডে একজনের ভাইভা নিয়ে পদোন্নতি দিতে হবে? পদোন্নতি দেওয়া তো এত জরুরি কাজ হতে পারে না।
২. আপনারা নতুন দায়িত্ব নিয়েছেন। আগে এই পদ্ধতির প্রতিষ্ঠানে কাজও করেননি। নতুন প্রতিষ্ঠান, নতুন পদ্ধতি, সবকিছু বোঝার জন্যও তো সময় প্রয়োজন। সে রকম কোনও সময় না নিয়ে এমন তড়িঘড়ি নিয়োগ, পদোন্নতি আশঙ্কা তৈরি করছে ইসলামী ব্যাংকের ভবিষ্যৎ নিয়ে। সরকারি মালিকানার সোনালী থেকে বেসিক ব্যাংক যে দেউলিয়ার পর্যায়ে চলে গেছে বা যাচ্ছে, তা তো নানা স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়মের কারণেই। ইসলামী ব্যাংককে জামায়াত সম্পৃক্ততা থেকে বের করে নিয়ে আসা নিয়ে তো আপত্তি নেই। এই বের করে আনার ক্ষেত্রে যে অভিযোগগুলো ছিল, তা এখন সরকারকে স্বচ্ছভাবে প্রমাণ করতে হবে। যেমন, ইসলামী ব্যাংকের অর্থ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বানচাল করার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে, জঙ্গিবাদ পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যবহার হয়েছে, ইত্যাদি। সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণ করে ব্যবস্থা নিলে জনমনে প্রশ্ন থাকবে না। তা না করলে, দখলের অত্যন্ত খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিগত স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ করে দেওয়া নিয়ে নিশ্চয়ই আপত্তি আছে। দেশের এক নম্বর ব্যাংককে বেসিক ব্যাংককে পরিণত করা নিয়ে নিশ্চয়ই আপত্তি আছে। জামায়াত সংশ্লিষ্টতা থেকে বের করে আওয়ামী সংশ্লিষ্টতায় পরিণত করা নিয়ে অবশ্যই আপত্তি আছে। আওয়ামী লীগ সরকার তার পছন্দের বা দলীয় মতাদর্শের লোকজনদের নিয়োগ দেবে, তা নিয়ে আপত্তি নেই। আওয়ামী লীগের মতাদর্শ ধারণ করেন, এমন যোগ্য ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ দেশে আছেন। পরীক্ষাপদ্ধতি অনুসরণ করে, উত্তীর্ণ হয়ে তারা নিয়োগ পেতে পারেন। আওয়ামী মতাদর্শের এমন চাকরিপ্রার্থীও দেশে আছেন। এসব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নিজেদের লোকজন নিয়োগ দিলে, কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। আপত্তি করলেও তা গুরুত্ব না দিলেও চলে। জামায়াত তাদের অনুসারী লোকজন দিয়েই ব্যাংকটি পরিচালনা করেছে। জামায়াত করে কিন্তু অযোগ্য, এমন কাউকে নিয়োগ দিয়েছে, পরীক্ষা ছাড়া নিয়োগ দিয়েছে, ৪১ সেকেন্ডে ভাইভা নিয়ে পদোন্নতি দিয়েছে, এমন অভিযোগ কখনও শোনা যায়নি। এমন অভিযোগ যদি থাকত, তবে আর যাই হোক ইসলামী ব্যাংক দেশের এক নম্বর ব্যাংক হিসেবে টিকে থাকতে পারত না।
৩. বেসরকারি ব্যাংক সরকার পরিচালনা করে না। ইসলামী ব্যাংকে যা ঘটছে, সরকার বলতেই পারে যে, তার দায় নেই। বলতেই পারে যে, এমডি, চেয়ারম্যান, পরিচালনা পরিষদ করছে সবকিছু। বাস্তবতা হলো, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী ঘটছে সবকিছু। সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গ্রুপ যে সিংহভাগ মালিকানায় চলে এসেছে, তাও এমনি এমনি ঘটেনি।
ফলে প্রশ্নটি খুব বড় করে সামনে আসছে যে, সরকার কি সৎ উদ্দেশ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধী থেকে ‘মুক্ত’ করল ইসলামী ব্যাংক, না কয়েকজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিকে দিয়ে ‘দখল’ করানো হলো? ‘দখল করানো হয়নি’- ওপরে উল্লিখিত দু’টি ঘটনা তা বলে না।
সততা অপরিহার্য সবক্ষেত্রেই, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে একটু বেশি প্রয়োজন। সততা থাকে বলেই ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ নোবেল পুরস্কার অর্জন করে, পৃথিবীর অন্যতম মডেল হওয়ার গৌরব অর্জন করে। সততা থাকে বলেই বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান ‘ব্র্যাক’ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এনজিও’র সম্মানে ভূষিত হয়, দেশের মানুষকে সম্মানিত করে। সততা থাকে না বলেই সরকারের ব্যাংক, শিল্প-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ডুবে যায়। অসততার কারণেই লাভজনক বেসিক ব্যাংক পাঁচ-সাত বছরে প্রায় দেউলিয়া হয়ে যায়। দেশের এক নম্বর সফল, লাভজনক ইসলামী ব্যাংকও বেসিক ব্যাংকে পরিণত হবে, বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও ঘটনাক্রম আশঙ্কা প্রবলভাবেই তৈরি করে।
জামায়াত ‘মুক্ত করা’ আর ঘনিষ্ঠ লোকজন দিয়ে ‘দখল’ করা- দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়।
প্রত্যাশা ছিল ‘মুক্ত করা’র পথে হাঁটবে সরকার। বাস্তবে হাঁটছে ‘দখল’ করার পথে। যা আগামীতে প্রতিষ্ঠান দখলের প্রতিযোগিতার ইঙ্গিত বহন করছে।
৪. নিয়োগ বা পদোন্নতির মধ্যে কর্মকাণ্ড সীমিত থাকবে, ভাবার কারণ আছে বলে মনে হয় না। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া চলার সময় চরম সংকটকাল অতিক্রম করছে জামায়াত। জামায়াতের এই সংকটকালের সুযোগ প্রগতিশীল রাজনীতিবিদরা অনেকেই নিয়েছেন। নানাভাবে নিয়েছেন। যদিও এই ‘নানা ভাব’ প্রমাণ করা যাবে না। প্রমাণ করা যাবে, চাপে ফেলে ঋণ নেওয়ার ঘটনাগুলো। ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা নেই, তবু ঋণ নিয়েছেন। ইসলামী ব্যাংকের আগের নেতৃত্ব কখনও দিতে বাধ্য হয়েছে, কখনও ইচ্ছে করে হাতে রাখার জন্যে সংকট থেকে বাঁচার জন্য এসব ঋণ দিয়েছে। এসব ঋণের অনেকগুলোই ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাও হয়তো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব ছিল, বিপুল লাভ থেকে। পরিবর্তিত নেতৃত্বের এই সময়ে, নিয়োগ-পদোন্নতি স্টাইলে যদি ‘ঋণ’দেওয়া শুরু করা হয়, তবে পরিণতি কী হবে? সোনালী, জনতা, রূপালী, অগ্রণী বা বেসিক ব্যাংকে পরিণত হবে ইসলামী ব্যাংক?
ইসলামী ব্যাংকের ভাগ্যে কী ঘটে, তা দেখা বা জানার জন্য, খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে নাও হতে পারে!
লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক
পাঠকের মতামত: